উপভোগ্য ছিলে বৈচিত্র্যময় তৈনখালের জলজীবন

0 7,946
লেখকঃ শহীদুল হক তানভীর
আলীকদমে_প্রথম_দিন…
৬ আগস্ট ২০২২…
বহুদিন হইল প্লানিং করতাছি বান্দরবান এ ঢু মারার। সময় সুযোগ আর ট্যুরমেট পাচ্ছি না সে লেভেলের তাই আর আগানো গেলো না। ইনকোর্স এক্সাম চলাকালে হুটহাট ৩/৪ জন পেলাম পালানোর। পরিচিত কয়েকজনকে ম্যাসেজ করলাম তবে তারা সময় সুযোগ মিলাতে পারছেন না। যাইহোক এবার আমি যাবোই। আচ্ছা এক্সাম শেষে দিনক্ষণ নিদিষ্ট করা হবে। ঠিকঠাক পরিকল্পনা সাজাচ্ছি এমন সময় আরো দুই বন্ধু শিউর হলো যাবে বলে। এখন আমরা ৭ জনের ব্যালেন্স একটা টিম। এদিকের তোহা,আসিফ,রাকিব সাথে দক্ষিণ পাড়ার নয়ন ভাই, আরিফ ভাই এবং তাহের ভাই।
রাতে বাজার সাজার করে ব্যাকপেক গুছিয়ে রেখেছি। হঠাৎ নিউজ দেখলাম তেল আর অকটেনের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে চট্টগ্রাম গণপরিবহন কাল বন্ধ থাকবে। হতাশা নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। বাড়তি একটা আশঙ্কা ভর করছে মনে। ঘুৃম আসছে না। এটা আমার অভ্যাস সকালে কোথাও যাওয়ার প্লানিং থাকলে রাতে স্বাভাবিক ঘুম হয় না। যাক আল্লাহ ভরসা কোনো একটা ব্যবস্থা হবে এই আশায় ঘুমালাম।
সকাল ৪ টায় উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে রেডি হয়ে বিসমিল্লাহ বলে বেরিয়ে গেলাম। যাত্রা শুরু পৌঁছালাম ১১ নাম্বার ঘাটে। দেখলাম আমরা ছাড়া ঘাটে কোনো যাত্রী নেই। বোট কি’বা মাঝি মাল্লাদেরও দেখছিনা আশেপাশে। নাকী তেলের দামে বোটও আজ বন্ধ! না তা না কিছুক্ষণ অপেক্ষা শেষে ঐ দূরে দেখলাম একটা যাত্রীবাহী বোট আসছে। উঠে পড়লাম আমরা। কটকট শব্দের সাথে পানির এলোমেলো স্রোত সকালের নরম আবহাওয়া, সূর্যোদয়ের মিষ্টি ঝিলিক, পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙানো এই দৃশ্য যেন শত কোটি টাকার।
ঘাট পার হয়ে সিএনজি যোগে ক্রসিং পৌঁছলাম। হালকা চা নাস্তা করে কক্সবাজারগামী বাসে উঠে বসলাম উদ্দেশ্য চকরিয়া বাস স্টেশন। সকাল ৯ টা ছুঁই ছুঁই আমরা চকরিয়া পৌঁছে চান্দের গাড়ির সন্ধান করতেই সেখানেও তেলের দাম বৃদ্ধিতে আজ থেকে বাড়তি ভাড়ায় গুনতে হবে যাত্রীদের। অনেক কথাবার্তা বলেও কিছু ছাড় পেলুম না লেট হচ্ছে তাই লোকাল মাইক্রোতে উঠে গেলাম। সকাল ১১ টায় আলীকদম গিয়ে থামলো আমাদের যাত্রা।
এবার হালকা ঝাল নাস্তা সেরে হাঁটা ধরলাম পান বাজারের দিকে। বাজারে গিয়ে যে যার মতো স্লিপার, টুকটাক বাজার, গাইড ম্যানেজ, এনআইডি প্রিন্ট সবমিলিয়ে ১২ টা শেষে টমটমে আমতলী হয়ে মাতামুহুরি হতে আমাদের বোট যাত্রা শুরু। সবুজাভ পাহাড়ে দুপাশ ঘেরা আঁকাবাকা পানির মিতালি সাথে পাহাড়ি চূড়ায় জুমখেতের ঔজ্জ্বল্য দেখতে বেশ চমকপ্রদ ঠেকছে। শ্রাবণের শুভ্র নির্মল মেঘ সাথে প্রচন্ড তীব্র রোদেও উপভোগ্য ছিলে বৈচিত্র্যময় তৈনখালের জলজীবন।
টুকটাক ফটোগ্রাফি সাথে বিচ্ছিন্ন গানের সুর এইতো চলে এলাম দোসরী বাজার। বাজারের পাশেই সেনা ক্যাম্প। সেনা সদস্যদের কাছে আমাদের টিমের এন্ট্রি শেষে আজকের ট্রেকিং এখান থেকেই শুরু। ছোটো ছোটো ঝিরি, কলা বাগান, দৈত্যের মতো দাড়িয়ে থাকা পাহাড়, বাঁশ ও বেড়ার মাচাং ঘর সাথে পাহাড়ি আদিবাসীদের সাদামাটা জীবন অবলোকন। এই তো চলছে আমাদের পথচলা…
ঝিরির বড় বড় বোল্ডার গুলোর জন্য যাত্রা মোদের ধীরগতি হচ্ছিল। মাঝে মাঝেই জলের অতিরিক্ত ফ্লো সাহস ও সতর্কতার সঙ্গে পাড়ি দিতে হয়েছে। পরক্ষণেই চিন্তা করলাম প্রতি বছর ঝর্ণা, খাল ও নদীতে এতো মানুষ কেমনে মারা যায়। সামান্য জলের ফ্লো আমাকে যেন টেনে নিয়েই যাচ্ছিলো বারবার শক্ত কদমে নিজেকে সামলাতে হয়েছে অতি সাবধানে।
এবার পৌঁছালাম রাইতুমনি পাড়ায়। দেখলাম কয়েকজন বয়োঃবৃদ্ধ পাহাড়ি একসাথে বসে খোশগল্প করছে। আমাদের গাইড ইমরান ভাই তাদের চিনতে পেরে মুসাফাহা করে গল্পে শরীকানা দিলো। এদিকে আমরাও পানি আর খেজুর চকোলেট খেয়ে নিলাম।
আবারো পথচলা শুরু….. ঝিরি ধরেই হেটে চলেছি আর থামাথামি নাই। এবার সেই কাঙ্ক্ষিত থাংকোয়াইন জলপ্রপাতের দেখা মিললো। মনে হলো যেন সকল ক্লান্তি অবসাদ নিমিষেই ভুলে গেলাম। পানি তুলনামূলক কম ছিলো অর্থ্যাৎ ভরা যৌবন পেলামনা। তাতে কি যদ্দুর আছে তাতেই এক চিলতে কমতি হবেনা চিল এ। স্বচ্ছ পানিতে লাপালাপি শেষে ঘর্মাক্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছি থাংকোয়াইনের শীতল বিছানায়। এবার উঠতে হবে আরো কিছু পথ বাকি এখনো।
 
জলপ্রপাতে গোসল শেষে টুপটাপ শব্দ আহ সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি এসে হাজির। শরীর ভেজা তাই আর রেনকোট জড়ালাম না গায়ে। হাঁটছি আমরা সামনের পাড়াতেই আজকের রাতটা কাটাবো। বৃষ্টি আরো জোরেশোরে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের আদ্যোপ্রান্ত। পাহাড়ে বৃষ্টি মানেই জোকের ভয়। হলোও তাই হঠাৎ দৃষ্টি আটকালো তাহের ভাইয়ের পায়ে একটা জোকের নাচানাচি। ভয়ে কেউ কাছেই যাচ্ছে না। পরে আমি নামালাম সেই জোক। ঐদিকে বৃষ্টির সুবাদে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে মেঘগুলো খেলা করছিলো। গাঢ় কালো অন্ধকার মেঘে ছেয়ে গেছে পুরো পাহাড়। মেঘেরা দলবেঁধে স্তুপাকারে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘের সাথে পাহাড়ের এই মিতালি যেন স্বর্গের প্রতিচ্ছবি। মনের অজান্তেই আমি বলে উঠলাম সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ তোমার সৃষ্টি এত্তো সুন্দর না জানি তুমি কতো সুন্দর।
ট্রিপের শুরু থেকেই সবাই বৃষ্টি খুঁজছিল সেই আশায় পূর্ণতা দিলো আল্লাহ পাক। উঠছি একদম খাড়া একটা পথ সাথে ভেজা মাটির পিচ্ছিল কাদা খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পা ফসকালেই গভীর খাদে হারিয়ে যাবে যে কেউ।
কাক ভেজা হয়েই হাজীরাম পাড়ায় পৌঁছাতেই বিকাল ৫.৩০। রাত কাটাতে জনপ্রতি ২০০ খুঁজছে পাড়ার মানুষ। আমরা স্টুডেন্ট বলে বুঝানোর পরও কমানো যাচ্ছে না, কম নিবেই না। পরে হঠাৎ ইমরান ভাইয়ের বন্ধু পাড়ার কারবারির মেয়ে হ্যাপি আপুর বর খালেকের সাথে দেখা। তোহা, আপুর সাথে কথা বলে নানাভাবে বুঝিয়ে জনপ্রতি ১০০ টাকায় থাকার জন্য রাজি করালো। এবার রেস্ট করার পালা। সে কি আতিথেয়তা পেলাম রিসের বাড়িতে আহ যেন আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ কারো বাড়ী। রিস হ্যাপি আপুর ছোট ভাই কারবারির ছেলে। কলেজে পড়ে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। দারুণ এক মমতা মিশিয়ে এটা সেটা এনে দিলো বাড়ির সদস্যরা। এই বাড়িটি পাড়ার অন্যান্য বাড়ীর তুলনায় বেশি সুন্দর, পরিপাটি, গোছানো সাথে সোলার কারেন্ট ছিলো এবং যথেষ্ট ভালো মানের শৌচাগার। আর কি লাগে এ জীবনে?
ফ্রেশ হয়ে অযু করে যোহর আসরের কসর পড়তে যাবো এমন সময় হঠাৎ একটা ইয়া বড় টাইগার জোকের দেখা। ঘাবড়ে গেলাম সবাই এ জোক কোত্থেকে কার শরীর হতে নামলো। সবাই খোঁজাখুঁজি করেও পেলুৃমনা। আমি লুঙ্গি পড়ে নামাজে দাঁড়ালাম। নামাজ শেষে লক্ষ্য করলাম লুঙ্গিতে রক্তের চাপ। পেন্ট তুলতেই দেখি আমার পা ভর্তী রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জীবনে এত্তো রক্ত আমার কখনো বের হয়নি। দুশ্চিন্তায় চরম বিষাদে গ্রাস করলো আমাকে। খালি চিন্তা করতেছি কেমনে কবে এ জোক আমাকে ধরলো একটুও টের পেলুমনা আমি! রক্ত পরিষ্কার করে ধুয়ে নিলাম। না রক্ত কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না দীর্ঘ ৫ ঘন্টা রক্ত ছুটেছে।
ওইদিকে বিশিষ্ট শেভ আমাদের তাহের বদ্দা গরমাগরম সুস্বাদু নুডলস নিয়ে হাজির। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা যাহাই পেলাম চেটেপুটে তৃপ্তি সহকারে খেলাম। আফসোস নুডলস এতো তাড়াতাড়ি শেষ না হলেও পারতো। এত্তো মজাদার কেন লাগছে আমার, কই বাসায় তো এক প্লেটও শেষ করতে পারিনা। ক্ষুধার জ্বালায় বোধহয় এমন লাগছে । এ নুডলস আমার কাছে অমৃতর মতো লেগেছে।
খাওয়া শেষে গল্পের আসর, গল্পজল্পে ব্যাক্তিগত জীবনের ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। বিশ্রাম শেষে আড্ডা জমিয়ে রাতের খাবার প্রস্তুতি চলছে। খাবার মেনুতে আছে জুমের চালের ভাত, আলু ভর্তা, মশুর ডালের মিক্সিং ঝোল এদ্দূর। এতেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি আমরা। এবারও তাহের ভাই দারুণ খাইয়েছেন সাথে তোহা আর নয়ন ভাইয়ের সহযোগিতায় আলু ভর্তার জিহ্বা রসালো রেসিপি। এবার একটা লম্বা ঘুমের দরকার। হ্যাপি আপু কাঁথা, কম্বল নিয়ে এসেছে আমরা বিছানা গুছিয়ে তলিয়ে গেলাম চরম শান্তির ঘুমে। দেখা হচ্ছে কাল।  আহ… এটাই তো জীবন।
চলবে…………………
Leave A Reply

Your email address will not be published.