চন্দ্রনাথ পাহাড় কখনো আমায় হতাশ করেনি, সবসময় তার সবকিছু উজাড় করে দিয়ে আপন করে নিয়েছে আমায়।
ছবি ও লিখাঃ ইসমাইল হোসেন নয়ন
চন্দ্রনাথ পাহাড় চট্টগ্রাম এর সীতাকুণ্ড বাজার থেকে ৪কি.মি. পূর্বে অবস্থিত একটি পাহাড় যা দর্শনার্থীদের কাছে চন্দ্রনাথ ট্রেকিং এর জন্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটা রুট। চন্দ্রনাথ পাহাড় এর উচ্চতা আনুমানিক ১০২০ ফুট। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার জন্যে ২টা রাস্তা আছে। ডানদিকের দিকের রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁড়ি আর বামদিকের রাস্তাটি পুরোটাই পাহাড়ী পথ, কিছু ভাঙ্গা সিঁড়ি আছে। বাম দিকের পথ দিয়ে উঠা সহজ আর ডানদিকের সিঁড়ির পথ দিয়ে নামা সহজ, তবে আপনি আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী পথ ব্যবহার করতে পারবেন।
১৭ই আগষ্ট ২০২০ ইংরেজি। ভোর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে আগেরদিন রাতেই বন্ধু কাইসার হামিদ বড় ভাই মোহাম্মদ তাহের এবং আমাদের সাথে এবং প্রথমবারের মতো পাহাড়ে ট্রেকিং এর ইচ্ছে প্রকাশ করা বিজয় নগরের জাহিদ শুভ মামাকেও কল দিয়ে জানিয়ে রেখেছিলাম। ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে পতেঙ্গা থেকে কাইসারকে সঙ্গী করে বিজয় নগর থেকে তাহের ভাই এবং শুভ মামাকে নিয়ে পৌছে গেলাম একে.খান মোড়।
কোন বৃষ্টি নেই আকাশ পরিস্কার হচ্ছে আস্তে আস্তে। সীতাকুণ্ডগামী বাসে উঠলাম চারজনেই সিটি গেইট পার না হতে পুরো আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে এবং শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। আহা.. আজ মেঘেদের সাথে কথা হবে। এসে গেলাম সীতাকুণ্ড বাজার সাধারণত সীতাকুণ্ড বাজার থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে আমরা হেঁটে যায় কিন্তু যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে তাই সিএনজি করে গেলাম পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত।
বৃষ্টিতে পাহাড় ট্রেকিং পূর্ব অভিজ্ঞতা আমার আর তাহের ভাইয়ের আছে কিন্তু, কায়সার আর শুভ মামার নেই। তবে কাইসারের যে এনার্জি তার কষ্ট হবেনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম।
শুরু হলো ট্রেকিং, একেবারে পর্যটক শূন্য ও তীর্থ স্থানেও নেই তেমন মানুষ। সামান্য উঠতেই দেখা পেলাম বানরের। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ২০১৯ সালের নভেম্বরেও বানর দেখেছিলাম ৩/৪ টা তবে তবে সাইজে ছোট ছিল। কিন্তু এবার যাদের দেখছি তাদের দেখেই বুঝা গেল তারাই রাজা বানরদের। এর আগে জঙ্গলে, পাহাড়ে কখনো এতোবড় বানর আমি দেখিনি তাও একসাথে ১৫/২০ টা মতো। আমি আর তাহের ভাই অনেক্ক্ষণ ওদের কান্ড দেখলাম খুব ভাল্লাগছিল। এদিকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আবারো মুষলধারে বৃষ্টিতে পরিণত হলো। আহা কি আনন্দ.. ইলেকট্রনিক গেজেটগুলো পলিথিনে মুড়িয়ে নিলাম। বৃষ্টিতে পাহাড় ট্রেকিং অনবদ্য যারা বৃষ্টিতে পাহাড়ে ট্রেকিং তারাই বুঝবে এই ট্রেকিং যে কত মধুর। তবে, বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে পড়ে যাওয়ার আশংকাও কম নয়। সেক্ষেত্রে পাহাড়ে ট্রেকিং উপযোগী স্যান্ডেল পড়ে যাবেন।
প্রথম স্টেফ শেষ হলো সেখান থেকেই মেঘের আনাগোনা শুরু। শুভ মামা তো মেঘ দেখে রীতিমতো অবাক উনার এই খুশি দ্বিমাত্রিক বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমি বললাম, মামা আপনে কিন্তু একটি ব্যাপার এখনো খেয়াল করেননি, আপনি কিন্তু হেঁটে হেঁটে বর্তমানে মেঘের উপরে অবস্থান করছেন। মুহুর্তে মামা আরো বেশী খুশী হলেন। ঐ যে বললাম কাইসার অভিজ্ঞতা নাই বৃষ্টিতে পাহাড়ে ট্রেকিং এর। সে কাইসার আমাদের আগেই চূড়া’তে উঠে বসে আছে গায়ের সাদা গেঞ্জি খুলে আমাদের সিগনাল দিচ্ছে।
আমরাও উঠে গেলাম মেঘেদের শীতল ছোঁয়া নিতে নিতে। ছবিতে খেয়াল করলে বুঝবেন কি পরিমাণ মেঘ ছিল তখন। কেউ নেই শুধু আমরা চারজনই সাথে সাথে বসিয়ে দিলাম জীবনজুয়ার আসর। সুখ দুঃখের বাক্স খুলে উড়িয়ে দিয়েছে ঐ শুভ্র মেঘেদের কাছে। আমি চন্দ্রনাথ পাহাড় বহুবার সামিট করেছি তবে এতোক্ষণ অবধি কখনো চূড়া’তে অবস্থান করিনি। এবারই দীর্ঘ সময় ধরে চূড়ায় অবস্থান করছি।
কথায় আছে না ছবি গল্প বলে৷ ছবিগুলো দেখুন এরাই গল্প বলবে।
চন্দ্রনাথ পাহাড় কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে এসি, ননএসি বাস ছাড়ে সায়দাবাদ বাস ষ্টেশন থেকে। আরামদায়ক এবং নির্ভর যোগ্য সার্ভিস গুলো হল এস.আলম, সৌদিয়া, গ্রীনলাইন, সিল্ক লাইন, সোহাগ, বাগদাদ এক্সপ্রেস, ইউনিক প্রভূতি। সবগুলো বাসই সীতাকুণ্ডে থামে। চট্টগ্রাম থেকে বাসগুলো মাদারবাড়ী, কদমতলী বাসষ্টেশন থেকে ছাড়ে। তা ছাড়াও অলঙ্কার থেকে কিছু ছোট গাড়ী ছাড়ে ( স্থানী ভাবে মেক্সী নামে পরিচিত) সেগুলো করেও আসা যাবে।
এছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়েঁ আসা দ্রুতগামী ট্রেন “ঢাকা মেইল” সীতাকুণ্ডে থামে, এটি ঢাকা থেকে ছাড়ে রাত ১১টায় এবং সীতাকুণ্ডে পৌঁছে পরদিন সকাল ৬.৩০ থেকে ৭টায়। অন্যান্য আন্তঃ নগর ট্রেন গুলো সরাসরি চট্টগ্রামে চলে যায়। শুধুমাত্র শিবর্তুদশী মেলার সময় সীতাকুণ্ডে থামে।
সীতাকুন্ড বাজার থেকে CNG (জনপ্রতি ২০/-) নামিয়ে দিবে পাহাড় এর প্রবেশ ফটকে। এখান থেকেই ট্রেকিং এর শুরু। সাধারণত ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগবে পাহাড়ের চূড়ায় পৌছাতে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে আপনি নিজ উদ্যোগে পারিবারিক ভাবে সিএনজি অটো রিক্সাতে করে ঘুরে আসতে পারবেন ভাড়া নিবে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আপনি যদি পাবলিক বাসে যেতে চান তবে আপনাকে নগরির অলংকার কিংবা এ কে খান মোড় থেকে বাসে উঠতে হবে ভাড়া নিবে ২০ টাকা প্রতি জন।
কোথায় থাকবেন
আদার ব্যাপারী তথ্যানুসারে, সীতাকুন্ড কাঁচা বাজার এলাকায় এবং সীতাকুণ্ড থানা সংলগ্ন এলাকায় মোটামুটি মানের অল্পকিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে যাদের মধ্যে হোটেল কম্পোট জোন, জলসা, নিউ সৌদিয়া, সৌদিয়া, সায়মন উল্লেখযোগ্য। হোটেল কম্পোট জোন, জলসা, নিউ সৌদিয়া অপেক্ষাকৃত নতুন এবং মান ভালো। এদের রুম ভাড়া এসি ডাবল বেড – ১০০০ টাকা এবং নন এসি ৫০০-৭০০ টাকার মধ্যে।
এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের যে কোনো মানের হোটেল বা রেস্টুরেন্ট পেয়ে যাবেন। থাকা-খাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন মান ও দামের আবাসিক হোটেল-মোটেলের সুব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সীতাকুণ্ড অথবা ভাটিয়ারীতে থাকার জন্য আবাসিক সুব্যবস্থা রয়েছে। নীচে কয়েকটি বাজেট হোটেলে নাম ঠিকানা দেয়া হলো। এগুলোই সবই মান সম্পন্ন কিন্তু কম বাজেটের হোটেল।
হোটেল প্যারামাউন্ট, স্টেশন রোড, চট্টগ্রাম : নুতন ট্রেন স্টেশনের ঠিক বিপরীতে। আমাদের মতে বাজেটে সেরা হোটেল এটি। সুন্দর লোকেশন, প্রশস্ত করিডোর (এত বড় কড়িডোর ফাইভ স্টার হোটেলেও থাকেনা)। রুমগুলোও ভালো। ভাড়া নান এসি সিঙ্গেল ৮০০ টাকা, ডাবল ১৩০০ টাকা, এসি ১৪০০ টাকা ও ১৮০০ টাকা। বুকিং এর জন্য : ০৩১-২৮৫৬৭৭১, ০১৭১-৩২৪৮৭৫৪
হোটেল এশিয়ান এসআর, স্টেশন রোড, চট্টগ্রাম : এটাও অনেক সুন্দর হোটেল। ছিমছাম, পরিছন্ন্ হোটেল। ভাড়া : নন এসি : ১০০০ টাকা, নন এসি সিঙ্গেল। এসি : ১৭২৫ টাকা। বুকিং এর জন্য – ০১৭১১-৮৮৯৫৫৫
হোটেল সাফিনা, এনায়েত বাজার, চট্টড়্রাম : একটি পারিবারিক পরিবেশের মাঝারি মানের হোটেল। ছাদের ওপর একটি সুন্দর রেস্টুরেন্ট আছে। রাতের বেলা সেখানে বসলে আসতে ইচ্ছে করবেনা। ভাড়া : ৭০০ টাকা থেকে শুরু। এসি ১৩০০ টাকা। বুকিং এর জন্য – ০৩১-০৬১৪০০৪
হোটেল নাবা ইন, রোড ৫, প্লট-৬০, ও,আর নিজাম রোড, চট্টগ্রাম। একটু বেশী ভাড়ার হোটেল। তবে যারা নাসিরাবাদ/ও আর নিজাম রোড এলাকায় থাকতে চান তাদের জন্য আদর্শ। ভাড়া : ২৫০০/৩০০০ টাকা। বুকিং এর জন্য – ০১৭৫৫ ৫৬৪৩৮২
হোটেল ল্যান্ডমার্ক, ৩০৭২ শেখ মুজিব রোড, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম : আগ্রাবাদে থাকার জন্য ভালো হোটেল। ভাড়া-২৩০০/৩৪০০ টাকা। বুকিং এর জন্য: ০১৮২-০১৪১৯৯৫, ০১৭৩১-৮৮৬৯৯৭
বিশাল এক পাহাড়। এর উপরেই আছে এক জাগ্রত শিবমন্দির।
প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে শিবচতুর্দশী মেলা হয় চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। দেশ-বিদেশের অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আসেন মেলায়। প্রচলিত আছে, নেপালের এক রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পৃথিবীর পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এর মধ্যে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শিবমন্দির অন্যতম।
তোমরা উঠার সময় টং থেকে চা খাওনি….? পাহাড়ের খাঁজে বেশ কয়েকটি টং দোকান দেখতে পেয়েছ সেখানে বসে টুকটাক খাবার খেতে পারতে।
মনে রাখবেন মন্দিরটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। মন্দিরের ভেতরে শিব লিঙ্গ রাখা আছে। এর আশেপাশে অনেক সাধু-সন্নাসীরা বসে ধ্যান করেন। কেউ কেউ পূজো করে থাকেন। তাই এখানে হইহুল্লোড় না করে নিরবতা বজায় রেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা খুব বেশি না হলেও এর চূড়ায় ওঠার পথটি বেশ সরু এবং দুর্গম। কেউ তাড়াহুড়া করে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করবেন না। তাতে যেকোনো বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। তাছাড়া পাহাড়ে উঠতে, নামতে নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করুন। উল্টো পথে কখনো উঠতে কিংবা নামতে চেষ্টা করবেন না।